মোবাইল : ০১৩০৯-১৩৪০৫১, ই-মেইল : [email protected]

বিশুদ্ধ দ্বীনের কেন্দ্রভূমিতে স্মৃতিময় তিন দশক

আমার শিক্ষাজীবনের শুরু রাজশাহী শহরের হড়গ্রামে দারুস সালাম কামিল মাদ্রাসায়। অতঃপর ১৯৯৬ সালের মে মাসে নওদাপাড়াস্থ আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসার ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র হিসাবে শুরু হয় আমার পথ চলা। ততদিনে মারকাযের পশ্চিম পার্শ্বস্থ ভবনের রাস্তাসংলগ্ন অংশটির ১ম, ২য় ও ৩য় তলার ৪টি করে রুম কেবল নির্মিত হয়েছে। নীচতলার ১০১ নং রুমটিতে আমাদের ক্লাস হ’ত। মাওলানা দুর্রুল হুদা, ফযলুল করীম, মাওলানা রুস্তম আলী, রফীক মাদানী, মুয্যাম্মেল মাদানী প্রমুখ ওস্তাদজীরা আমাদের ক্লাস নিতেন। মুসলিম স্যার, আমীর স্যাররা জেনারেল ক্লাস নিতেন। প্রথম এসেই বুঝতে পারলাম এই মাদ্রাসার শিক্ষা পরিবেশ আগের মাদ্রাসার মত নয়। দারুস সালামে সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হওয়ায় যে আত্মবিশ্বাস তৈরী হয়েছিল, তা এখানে এসে ভেঙ্গে গেল। বিশেষ করে উর্দূ ভাষায় আমীনুন নাহু ও পাঞ্জেগাঞ্জ পড়াটা দুরূহ হয়ে উঠল। ক্লাসমেটদের মধ্যে আব্দুল হাসীবসহ বেশ কয়েকজন ছিল খুব মেধাবী। বুঝতে পারলাম এখানকার পড়াশোনা বেশ প্রতিযোগিতামূলক। এক উর্দূর ধাক্কায় ক্লাসের অবস্থান অনেকটা পিছিয়ে গেল। বেশ অনেকটাই। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে প্রায় তিন বছর লেগে গেল। ক্লাস নাইনে এসে মনে হ’ল আমি সেই মনোবল, সেই আত্মবিশ্বাস আবার ফিরে পেয়েছি। মাওলানা বদীউয্যামান, শায়খ আব্দুছ ছামাদ সালাফী, আখতারুল আমান মাদানী, সাঈদুর রহমান রিয়াযী, আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ, আব্দুর রায্যাক ভারতী প্রমুখ ওস্তাদদের সান্নিধ্যে তখন একটা চমৎকার ইলমী পরিবেশ বিরাজ করছিল মারকাযে। সহপাঠীরাও ছিল মেধাবী ও উদ্যমী। ফলে নবম শ্রেণী থেকে আলিম পর্যন্ত চারটি বছর ছিল ছাত্রজীবনে আমার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। ফালিল্লাহিল হামদ। আলিম সম্পন্ন করার পর আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশীপ পেলাম। প্রায় একই সাথে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় রেজাল্ট ভাল হ’ল। তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী ও ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ভর্তি পরীক্ষা মানেই ছিল মারকাযের ছাত্রদের জয়জয়কার। প্রথমদিকের সিরিয়ালে মারকাযের ছাত্ররাই থাকত বেশীরভাগ। অবশেষে ভর্তি হলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগে।

এদিকে মারকাযে তখন দাওরায়ে হাদীছ চালুর পরিকল্পনা শুরু হয়। ২০০৩ সালে আমাদের মাধ্যমেই মারকাযে দাওরায়ে হাদীছের প্রথম ব্যাচ চালু হ’ল। সহপাঠী ছিল আব্দুল আলীম, ইমামুদ্দীন, আব্দুছ ছামাদ, হাশেম আলী আর আরীফুল ইসলাম ভাই। পরে আব্দুল আলীম ভাই মদীনা চলে গেলে আমরা হয়ে গেলাম পাঁচ জন। ফজরের পর দু’টি ক্লাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া, তারপর ক্লাস শেষে দুপুরে ফিরে এসে বাদ আছর থেকে এশা পর্যন্ত দাওরা ক্লাস করা, এভাবেই ব্যস্ত সময়ের মধ্য দিয়ে কাটতো আমাদের নিত্যদিন। দাওরা ক্লাসে আমাদের তাফসীর পড়াতেন মাওলানা বদীউয্যামান। প্রতিদিন আমাদের সাথে ওস্তাদজীর প্রতিযোগিতা চলত আরবী ব্যকরণের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো নিয়ে কিংবা কখনও দুর্বোধ্য কোন বাক্যের অর্থ নিয়ে। কেউ হার মানতে চাইতো না। কখনও ওস্তাদজী আমাদের হারাতে পারলে বেজায় খুশী হতেন, কখনও আমরা জিতলে খুশী হতাম। সে ছিল এক দারুণ উপভোগ্য ইলমী প্রতিযোগিতা। খুব ভাল লাগত ক্লাসের সময়গুলো।

২০০৫ সালে আববা গ্রেফতার হলেন। মারকাযের উপর নেমে এল এক মহাবিপর্যয়কর কালো অধ্যায়। সেদিনগুলোর বিভীষিকা বর্ণনা করার মত নয়। মাদ্রাসাসহ আমাদের দাওরা ক্লাসও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকল। এর মধ্যে পরিবেশ কিছুটা স্বাভাবিক হলে ক্লাস আবার শুরু হ’ল। এসময় শায়খ আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ যে আগ্রহ ও একনিষ্ঠতা নিয়ে পড়াতেন, তা স্মরণযোগ্য। তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি মাহফিল সেরে ফজরের সময় মারকাযে উপস্থিত হলেও বাড়িতে না গিয়ে সোজা ক্লাসে চলে যেতেন এবং এমনভাবে পড়াতেন যেন দীর্ঘক্ষণ মুতালা‘আ দেখে এসেছেন। তাঁর চেহারায় সফরের ক্লান্তি তেমন পরিলক্ষিত হ’ত না। তাঁর এমন দক্ষতায় আমরা অবাক হতাম এবং অনুমান করতাম তিনি ছাত্রজীবনে কুতুবে সিত্তাহ বিস্তরভাবে ঘাটাঘাটি করার সুযোগ পেয়েছেন। আরেকটি মজার বিষয় ছিল, কখনও দেখা যেত বিশ্ববিদ্যালয়ে সহপাঠীদের পরীক্ষা থাকলে ছাত্র হিসাবে কেবল আমি একাই আছি। কিন্তু তাঁর পড়ানোর ক্ষেত্রে কোন শিথিলতা আসত না। নিত্যদিনের মত পূর্ণ বিশ্লেষণ সহকারে পূর্ণ ঘন্টাই পড়াতেন। একই কাজ করতেন শায়খ আব্দুছ ছামাদ সালাফীও। নিজেরই লজ্জা লাগত যে, উনারা আমার একার জন্য এত পরিশ্রম করছেন কেন! আজকে তো ক্লাসটা সংক্ষেপ করলেও পারতেন!

২০০৯ সালে যখন হতাশাজনক ছন্দপতনের যুগ শুরু হ’ল, যখন শায়খ আব্দুছ ছামাদ সালাফী ঘোষণা দিলেন যে, মারকাযকে স্কুলে পরিণত করা হবে এবং যুবসংঘ-এর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের মারকায থেকে তাড়ানোর লক্ষ্যে দাওরায়ে হাদীছ শ্রেণী বন্ধ করা হবে। কেননা এই ক্লাসের অনেকেই যুবসংঘ বা সোনামণি-এর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীল। আর শিক্ষকদের ক্লাস নিতেও নিষেধ করা হ’ল। আমরা তখন দাওরা শেষ বর্ষে। শায়খ আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ এই ঘোষণার জোরালো প্রতিবাদ করে বলেন, ‘আমতলায় বসে হলেও আমি দাওরায়ে হাদীছের ক্লাস নিব’। সেসময় ক্লাসরুমগুলো বন্ধ রাখায় আমরা মারকাযের বড় মসজিদের বারান্দায় ক্লাস করা শুরু করলাম। এই দুঃখজনক ইতিহাস বর্ণনা করার মত নয়।

ওস্তাদদের মধ্যে সর্বদা যাদের স্নেহ ভালোবাসায় সীক্ত হয়েছি, তাদের মধ্যে মাওলানা বদীউয্যামানের নাম সবার আগে আসবে। ছাত্রদের প্রতি তাঁর অকুন্ঠ স্নেহ-ভালোবাসা প্রবাদতুল্য। তাঁর সময়কালের ছাত্রদের মধ্যে এমন খুব কমই পাওয়া যাবে, যারা তাদের স্মরণীয় ওস্তাদদের তালিকার একদম প্রথমে তাঁর নাম আনবে না। এরপর আব্দুর রায্যাক বিন ইউসুফ, ফযলুল করীম, আব্দুছ ছামাদ সালাফী, আব্দুর রায্যাক ভারতী, আখতারুল আমান মাদানী, সাঈদুর রহমান রিয়াদী প্রমুখ ওস্তাদরা যে অন্তহীন ভালোবাসার বাহুডোরে আবদ্ধ করেছিলেন, তা ভোলার মত নয়। যদিও কালের পরিক্রমায় তাদের অনেকের গন্তব্যপথ আজ বিভিন্নমুখী, কিন্তু তাদের জ্বালানো জ্ঞানের যে মশাল অন্তরে নিরবধি দেদীপ্যমান, তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে শেষ করা যাবে না। আল্লাহ তাঁদের সকলকে রহমতের চাদরে আবৃত করুন। আমীন!

শিক্ষাজীবন শেষ করার পর ২০১১ সাল ও ২০১৮ সালে এক বছর মারকাযে শিক্ষকতা করেছি। বর্তমানে শিক্ষাবর্ষ ২০২৪-এ তাখাছ্ছুছ বিভাগে একটি ক্লাস নেই। ব্যস্ততার মধ্যে ক্লাস নেওয়া কঠিন হলেও যতটুকু সময় ছাত্রদের সাথে কাটাই, খুব উপভোগ করি। পরবর্তী প্রজন্ম গড়ার যে দায় ঘাড়ে চেপে আছে, তা শোধ করার সুযোগটুকু হাতছাড়া করতে চাই না।

আমার সহপাঠী, অগ্রজ-অনুজদের অনেকেই এ মারকাযের গেঁথে দেয়া দ্বীনে হকের চেতনা সম্বল করে সফলতার সাথে দাওয়াতী ময়দানে পদচারণা করে যাচ্ছেন। এই দৃশ্য অবশ্যই পরিতৃপ্তিকর। হাফেয আখতার মাদানী, ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, ড. নূরুল ইসলাম, হাফেয আব্দুল মতীন মাদানী, ড. মুযাফ্ফর বিন মুহসিন, ড. ইমামুদ্দীন বিন আব্দুল বাছীর, আব্দুল আলীম মাদানী, হোসাইন আল-মাহমূদ, ড. হাশেম আলী, আরীফুল ইসলাম (বাবু), শরীফুল ইসলাম মাদানী, ড. আব্দুল্লাহিল কাফী মাদানী, মীযানুর রহমান মাদানী, মুকার্রম বিন মুহসিন মাদানী, আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রায্যাক মাদানী, সোহাইল বিন আকবর মাদানী, ড. গোলাম কিবরিয়া মাদানী, আব্দুল্লাহ বিন আব্দুর রহীম, রবীউল ইসলাম, আব্দুল্লাহ আল-মারূফ প্রমুখের মত মারকাযের বহু প্রাক্তন ছাত্র মারকাযের পবিত্র আমানতের ঝান্ডা সাধ্যমত বহন করে চলেছেন। সহযাত্রী হিসাবে আজ তাদের বড় একটা অংশকে না পাওয়ার বেদনা থাকলেও অন্ততঃ পথযাত্রী হিসাবে তাদেরকে দাওয়াতী ময়দানে দেখাটাও কম প্রশান্তির নয়।

সর্বোপরি মারকাযে কাটানো প্রায় ৩০ বছরের এই সুদীর্ঘ সময় আমার জন্য মহান আল্লাহর দেয়া এক মহা নে‘আমত। মারকায আমাদের জীবনটাকে সাজিয়ে দিয়েছে, অর্থপূর্ণ করেছে, আমাদের প্রজন্মের একটা অংশকে জাতিগঠনের কর্তব্য পালনে নিয়োজিত রেখেছে-এ কথা ভাবতেই হৃদমাঝারে প্রশান্তির সুশীতল প্রস্রবণ বয়ে যায়। গর্ববোধ করি যখন ভাবি-প্রায় ৩ যুগ ধরে ধাপে ধাপে লক্ষ-কোটি হকপন্থীর নিয়মিত গন্তব্য হয়ে ওঠা এই মারকাযকে দেশব্যাপী এক আপোষহীন আদর্শিক আন্দোলনের সূতিকাগার হয়ে উঠতে দেখার সাক্ষী হতে পেরেছি। তিন দশকে কত নেক মানুষের পদধুলি পড়েছে মারকাযে, কত বিদ্বজন-দেশবরেণ্যদের পদভারে ঋদ্ধ হয়েছে মারকায, তার হিসাব মেলা ভার। 

একই সাথে কত ঝড়ের করাল গ্রাস ধেয়ে এসেছে এ মারকাযকে ঘিরে, কত গাদ্দারীর কৃষ্ণ জিহবার লকলকে দংশনে পীড়িত হয়েছে মারকায, তবুও লক্ষ্যপানে এগিয়ে চলা থেকে চুল পরিমাণ বিচ্যুত হয়নি মারকায। বরং আঘাতের পর আঘাত সয়ে আজ অবধি আপন মহিমায় এ দেশের আহলেহাদীছদের একটি শক্তপোক্ত ঢাল হয়ে রয়েছে। বাধার বিন্ধ্যাচল অতিক্রম করে সীনা টান করে হক্বের ঝান্ডা ধরে রেখেছে নিরবধি। মহা দুর্যোগক্ষণগুলোতে কখনও কখনও মনে হয়েছে এ ধকল বোধহয় আর সইবার নয়, কিন্তু প্রতিবারই মহান রবের অশেষ রহমত, তাঁর গায়েবী মদদ আর এদেশের লক্ষ গণমানুষের দো‘আ ও ভালোবাসার পরিবেষ্টনে মারকায আবার কালো আধারের পর্দা গুটিয়ে নবপ্রভাতের স্নিগ্ধ আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে।

মুহতারাম আমীরে জামাআ‘ত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের তেজোদীপ্ত আপোষহীন নেতৃত্বের ঝলকানিতে এ মারকায পরিণত হয়েছে কালের এক অত্যুজ্জ্বল বাতিঘরে, যার বিকীর্ণ আলোকরেখা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে। এভাবে মারকায হয়ে উঠেছে মহাকালের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, যার প্রতিটি হরকতের বরকতে নিত্য রচিত হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের এক একটি অমূল্য অধ্যায়। আল্লাহ রাববুল আলামীন বাংলাদেশে আহলেহাদীছ আন্দোলনের সমকালীন অভিযাত্রার মূল দিগদিশারী এই মারকাযকে বিশুদ্ধ দ্বীনের মহাদুর্গ হিসাবে কিয়ামত পর্যন্ত অবিচল রাখুন এবং এর সৈনিক শিক্ষার্থীদেরকে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠায় এক একজন মুখলিছ, মুত্তাকী বীর মুজাহিদ হিসাবে কবুল করে নিন।-আমীন!

লেখক : ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
চেয়ারম্যান, হাদীছ ফাউণ্ডেশন শিক্ষা বোর্ড, রাজশাহী